বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ মাটি ও পানি : জীবনের উৎস
মোঃ জালাল উদ্দীন
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (World Soil Day প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর উদ্যাপন করা হয়। ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স (IUSS) কর্তৃক মাটি নিয়ে প্রতি বছর একটি উৎসব বা অনুষ্ঠান করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। থাইল্যান্ড এর রাজার নেতৃত্বে এবং গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ এর কাঠামোর মধ্যে, FAO বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির প্ল্যাটফর্ম হিসাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বা সূচনাকে সমর্থন করে। ২০১৩ সালের জুন মাসে ঋঅঙ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালনের ধারণাটিকে অনুমোদন করা হয় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের অনুরোধ জানানো হয়। ডিসেম্বর ২০১৩ সালে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করে। থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব প্রচার-প্রসারের জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজার জন্মদিনও বটে। তাঁর অনবদ্য কাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এ দিনটিকে বিশ^ মৃত্তিকা দিবস উদ্যাপনের জন্য নির্বাচন করা হয়। সারা বিশ্বে দিনটিকে মাটির স্বাস্থ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিজ্ঞানী, ছাত্র, কৃষকদেরকে অবহিত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য সুস্থ মাটির গুরুত্বের উপর সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রতি বছর আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য (Tteme) ব্যবহার করা হয়।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI) কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এবারও দেশব্যাপী ৫ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩’ পালন করতে যাচ্ছে। এ বছরের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য “ঝড়রষ ধহফ ডধঃবৎ : Soil and Water : a source of life” যার বাংলা ভাবার্থ-মাটি ও পানি : জীবনের উৎস। মাটি এবং পানির গুরুত্ব সর্ব মহলে অনুধাবনের জন্য এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে করি।
পৃথিবী নামক এ গ্রহকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটে মাটি ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের খাদ্যের শতকরা ৯৫ ভাগ উৎপাদিত হয় ভূমিতে, যেখানে মাটি ও পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই সর্বমহলে প্রাকৃতিক সম্পদ মাটি ও পানির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টেকসই এবং ঘাতসহিষ্ণু কৃষিখাদ্য ব্যবস্থা অর্জনে মৃত্তিকা ও পানির সম্পর্ক আমাদের জানতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যবস্থাপনার প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশে মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের গবেষণার অগ্রাধিকার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা প্রয়োজন। পানির দুষ্প্রাপ্যতা বা খরা এবং মৃত্তিকা অবক্ষয় রোধের জন্য টেকসই মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনার প্রসার এবং পারস্পরিক অংশগ্রহণ করা দরকার। ব্যবহারকারীদের কাছে মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুশাসনসমূহের পরিচিতি তুলে ধরতে হবে। টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা প্রসার, পানির দুষ্প্রাপ্যতা ও গুণগত মানসম্পন্ন পানির ব্যবহার ও পুনঃব্যবহার এবং মৃত্তিকা দূষণ কমিয়ে আনতে অংশীজনের সাথে যোগাযোগ এবং অংশীদারিত্বের কৌশলগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
তাত্ত্বিকভাবে মৃত্তিকা ও পানি নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও মানুষের অপরিকল্পিত ব্যবহারে মানুষের অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হতে পারে। মৃত্তিকা সৃজনের জন্য শত বছর থেকে লক্ষ বছর পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। এ অর্থে মৃত্তিকা অনবায়নযোগ্য। প্রাকৃতিক সম্পদ পানির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মৃত্তিকা ও পানির অবশ্যই যুক্তিসংগত ব্যবহার করতে হবে যেন এটি ভবিষ্যতের জন্য ব্যবহারযোগ্য থাকে। মানব, উদ্ভিদ, প্রাণী ও পরিবেশের জীবনে মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের ভূমিকা এবং এদের আন্তঃসম্পর্ক বুঝে এদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন-
মাটির পানিধারণ ক্ষমতা এবং উদ্ভিদের আহরণযোগ্য পানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সহনীয় মাত্রায় ভূমি অবক্ষয় এবং খরা নিরূপণে মৃত্তিকা জৈব কার্বনকে নির্দেশক হিসাবে ব্যবহারের উপযোগিতা বিশ্লেষণ করা, বৃষ্টিনির্ভর কৃষিতে পানির প্রাপ্যতা এবং মৃত্তিকা কার্বন সঞ্চয়নের জন্য উত্তম মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার চর্চাসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা;
মৃত্তিকা অবক্ষয় প্রতিরোধে দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা, পুষ্টি যোগানোর জন্য টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার বৃত্তাকার অর্থনীতিক পন্থাসমূহ, সেচনির্ভর ব্যবস্থায় মৃত্তিকা লবণাক্ততা হ্রাসে পানির মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা এবং উন্নত পুষ্টি ব্যবহার দক্ষতার জন্য উদ্ভাবনী সেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
একটাই স্বাস্থ্য এপ্রোচের (ঙহব ঐবধষঃয ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয) মৃত্তিকা স্বাস্থ্য এবং পানির মানের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা। ‘ওয়ান হেলথ এপ্রোচ’ হচ্ছে সমন্বিত এবং সম্মিলিত পন্থা যার লক্ষ্য হচ্ছে টেকসইভাবে মানব, প্রাণী এবং ইকোসিস্টেমের সুষম এবং সর্বোত্তম স্বাস্থ্য অর্জন। এই সহযোগিতামূলক, মাল্টিসেক্টরাল, ট্রান্সডিসিপ্লিনারি এপ্রোচটি স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে কাজ করে এবং মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং তাদের চারপাশের পরিবেশের আন্তঃসম্পর্কের স্বীকৃতি দেয়।
মৃত্তিকা ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধনের জন্য সরকারের উদ্যোগ এবং নীতিগ্রহণ; উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিস্তার যেমন: নির্ভুল কৃষি ((precision agriculture), দূর অনুধাবন (remote sensinৎ) এবং বৃহৎ ডাটা বিশ্লেষণ (big data analytics) প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং কার্যকর সমন্বিত মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য জেন্ডার বৈষম্য হ্রাস করা।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাসহ শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কর্তৃক বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন-
পাহাড়ি ঢালে ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ এবং অধিক ও নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য ঝাড়ের বেড়া প্রযুক্তির ব্যবহার।
সারা বছর ফসল উৎপাদন এবং ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রের জন্য পাহাড়ী ঢালে ধাপ (Bench Terrace) পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রযুক্তি।
ধসে যাওয়া/প্রায় ধসে যাওয়া ভূমি পুনরুদ্বারে জুট-জিও টেক্সটাইল (পাটের চট) প্রযুক্তির ব্যবহার।
লবণাক্ততা কবলিত এলাকায় শুকনো মৌসুমে ফসল চাষের কলস সেচ (Pitcher Irrigation) প্রযুক্তি।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় বর্ষাকালে শুধুমাত্র আমন ধানের উৎপাদন ছাড়া সারাবছর পতিত থাকে। কারণ শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির স্বল্পতার জন্য চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। এই পতিত জমিতে বিনা চাষে ডিবলিং এবং চারা রোপণ পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফসলের নিবিড়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চেলের জেলাসমূহের ঘেরের পাড়ের মাটি ও সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উচ্চমূল্যের ফসল তরমুজ চাষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
মধুপুরগড় অঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চল এবং পাহাড়ি অঞ্চলের কিছু অংশ অত্যন্ত অম্লীয়। আমাদের দেশে দিন দিন মাটির উর্বরতা ও ফসলের উপর অম্লীয় মাটির বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অম্লীয় মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেকসই ফসল উৎপাদন ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি কার্যক্রমসহ নানামুখী ব্যবস্থাপনা নেয়া হয়েছে।
পরিশেষে সুস্থ মাটি সুস্থ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে লক্ষ্যে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনসহ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এভাবে আশা করা যায় টেকসই ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদের লাভজনক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং মৃত্তিকা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব হবে। আমি বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ উদ্যাপনের সার্বিক সফলতা কামনা করছি।
লেখক : মহাপরিচালক, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ফোন : ২২২২৪২২২২১, ই-মেইল : dg@srd.gov.bd